বিস্তারিত
  • আইন বিশেষজ্ঞতের মতে খালেদার মামলার রায়ে যেসব সাজা হতে পারে


    বিশ্বনাথ বিডি ২৪ || 08 February, 2018, 11:49 AM || জাতীয়


    বহুল আলোচিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আজ বৃহস্পতিবার। এরই মধ্যে রায়কে ঘিরে দেশজুড়ে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় জোরদার করা হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

    এই মামলার প্রধান আসামি বিএনপির চেয়ারপারসন এবং তিনতিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ফলে দেশবাসীর আগ্রহ অন্যরকম। মামলার রায়ে কী হবে! সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সত্যিই কি সাজা হবে? সাজা হলে, তার ধরন কী হতে পারে? এমন সব প্রশ্ন নিয়েই জাতি তাকিয়ে আছে খালেদার রায়ের দিকে।

    জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে বিদেশ থেকে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলার রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অপরাধ প্রমাণিত হলে কী ধরনের শাস্তি হতে পারে তা নিয়ে আইনজীবী ও রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে ব্যাপক আলোচনা।

    বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও দলটির নেতাকর্মীরা মনে করেন, এ মামলায় খালেদা জিয়ার অপরাধ প্রমাণের সুযোগ নেই। ফলে বৃহস্পতিবার তিনি সসম্মানে আদালত থেকে ফিরবেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষসহ আওয়ামীপন্থী আইনজীবী ও দলটির নেতাদের বক্তব্য সম্পূর্ণ বিপরীত। দুদকের আইনজীবী এ মামলার রায়ে খালেদার সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দাবি করেছেন।

    ১০ বছর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা এ মামলায় দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ২৫ জানুয়ারি ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেন। মামলাটিতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ছয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

    এ মামলায় দণ্ডবিধি ও দুদকের দুইটি ধারা উল্লেখ করা হয়েছে। দণ্ডবিধির অপরাধ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর ‍দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছরের কারাদণ্ড হবে।

    তবে সাজা একবছরের নিচে হলে আপিল শর্তে বিবাদী তাৎক্ষণিক জামিনের আবেদনে যেতে পারবেন। তবে এ নিয়েও ভিন্নমত আছে।

    কী আছে মামলার ধারায়
    খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এ মামলাটি দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় করা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা অনুযায়ী, ‘যে ব্যক্তি তার সরকারি কর্মচারীজনিত ক্ষমতার বা একজন ব্যাংকার, বণিক, আড়তদার, দালাল, অ্যাটর্নি বা প্রতিভূ হিসাবে তাহার ব্যবসায় ব্যাপদেশে যে কোনও প্রকারে কোনও সম্পত্তি বা কোনও সম্পত্তির ওপর আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হইয়া সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করেন, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা ১০ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবে।’

    দুদক আইনের ৫(২) ধারায় বলা আছে, ‘কোনও সরকারি কর্মচারী অপরাধমূলক অসদাচরণ করিলে বা করার উদ্যোগ গ্রহণ করিলে তিনি সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের যোগ্য হইবেন।’

    দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মামলাটি সংবেদনশীল। আমরা তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছি। এখন রায়ের অপেক্ষা। তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি অপরাধ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন এবং দুর্নীতির ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।’

    একবছরের কম সাজা হলে খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতে হবে নাকি ওই আদালতেই জামিন চাইতে পারবেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যদি একবছরের কম সাজা হয়, তবে আপিলের শর্তে তিনি তাৎক্ষণিক জামিন চাইতে পারবেন।’

    এদিকে, মামলাটিতে দুর্নীতি বা দণ্ডবিধির কোনও অভিযোগই রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি বলে আবারও দাবি করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া। তিনি বলেন, ‘আদালতে দুর্নীতির মামলার যে ধারা সেটি বা দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা কোনোটিই প্রমাণিত হয়নি।’

    দু ধারার বাইরে বিজ্ঞ আইনজীবীর অভিমত কী?
    মামলা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের বাইরে আইন বিশ্লেষক ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিমকে খালেদা জিয়ার মামলায় শাস্তির বিষয়ে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে ধারায় মামলা হয়েছে তা যদি প্রমাণ হয়, তার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন এবং সর্বনিম্ন ১৪ বছরের জেল হবে। আদালত নিজ বিবেচনায় ভিন্ন দণ্ড দিতে পারেন। কিন্তু সর্বনিম্নের বাইরে যাওয়ার কোনও বিধান নেই। দুর্নীতি মামলায় যদি একবছরের নিচে সাজা হয় তাহলেও খালেদা জিয়া আপিল করতে পারবেন, কিন্তু সেটা কারাগারে গিয়ে তবেই করবেন।’

    কোনও মামলায় একবছর বা তার কম সময়ের শাস্তি হলে আপিল করার শর্তে জামিন পাওয়ার সুযোগ আছে কিনা এবং সেটি ওই আদালতেই তাৎক্ষণিক করা যাবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে সাজা একবছর হওয়ার সুযোগ একেবারেই নেই।’

    মামলার অভিযোগ
    জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই খালেদা জিয়াসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২০১০ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়াসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের উপ-পরিচালক হারুন অর রশীদ।

    অন্যান্য আসামি
    মামলায় খালেদা জিয়া ও বড় ছেলে তারেক রহমান ছাড়া বাকি আসামিরা হলেন– মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, সাবেক মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। মামলার ছয় আসামির মধ্যে খালেদা জিয়া জামিনে রয়েছেন। মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ কারাগারে থাকলেও তারেক রহমান, সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান পলাতক।

    খালেদা জিয়ার মাথায় আরো যেসব মামলা ঝুলছে
    জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাতের যে মামলাটির রায় আজ (বৃহস্পতিবার) হওয়ার কথা, সেটি দায়ের হয়েছিল ২০০৮ সালে তৎকালীন সেনা-সমর্থিত সরকারের সময়।

    মামলার অভিযোগ ছিল খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় তার স্বামীর নামে প্রতিষ্ঠিত এই দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে দুই কোটি ৫৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন।

    মামলা দায়েরের নয় বছর পর আজ (বৃহস্পতিবার) এর রায় দেওয়ার কথা। খবর বিবিসির।

    তবে রায় হলেও আরো চারটি দুর্নীতির মামলা লড়ে যেতে হবে খালেদা জিয়াকে। যে মামলাগুলোর তিনটিই দায়ের করা হয় ২০০৭ পরবর্তী তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে।

    জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা
    খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলাটি দায়ের করা হয় ২০০৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়।

    মামলার মূল অভিযোগ- প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় মিসেস জিয়া তার ক্ষমতা অপব্যবহার করে এই ট্রাস্টের জন্য ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকার তহবিল জোগাড় করেছিলেন।

    খালেদা জিয়ার একজন আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বিবিসিকে জানিয়েছেন এ মাসের ২৫ ও ২৬ তারিখে এই মামলার চূড়ান্ত সওয়াল জবাবের দিন ধার্য করা হয়েছে। তারপরই হয়তো বিচারক রায়ের দিন চূড়ান্ত করবেন।

    কানাডীয় প্রতিষ্ঠান নাইকোর সাথে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের চুক্তি করে রাষ্ট্রের প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকা লোকসান করার এই মামলাটি হয় ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত সরকারের সময়। মামলায় শেখ হাসিনাকেও আসামী করা হয়েছিল, কারণ এই চুক্তিটি প্রথম করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

    পরে ২০০৯ সালে সরকার প্রতিষ্ঠা করার পর শেখ হাসিনা আদালতের মাধ্যমে এই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে যান। তবে মামলাটি রয়ে যায় এবং আসামী হিসাবে থেকে যান খালেদা জিয়া।

    গ্যাটকো মামলা
    ঢাকার কমলাপুরে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে গ্যাটকো নামে একটি কোম্পানিকে দেওয়ার অভিযোগে এই মামলাটিও হয় ২০০৭ পরবর্তী সেনা-সমর্থিত সরকারের সময়।

    বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি মামলা
    খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০০৮ সালে দায়ের করা এই মামলার অভিযোগ ছিল -চুক্তিবদ্ধ কোম্পানি শর্ত ভেঙ্গে সরকারের চোখের সামনে অতিরিক্ত এলাকায় কয়লা খনন করে রাষ্ট্রের ক্ষতি করেছে, এবং খালেদা জিয়া রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন।

    নাইকো, গ্যাটকো এবং বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলায় পুলিশ এখনও চার্জশিট দেয়নি।

    বিএনপি সবসময় অভিযোগ করে, এই সব দুর্নীতি মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং হয়রানিমূলক। আইনজীবী মাসুদ তালুকদার বলেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৭-০৮ সালে তাদের বিরুদ্ধে করা এরকম শত শত মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করে নিলেও, বিএনপির করা আবেদনগুলো বিবেচনা করেনি।

    দুর্নীতির এই পাঁচটি মামলা ছাড়াও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরো ৩১টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি মামলা নাশকতার। সেইসাথে রয়েছে মানহানি এবং রাষ্ট্রদ্রোহের বেশ কিছু মামলা। ১৫ই আগস্টে তার জন্মদিনটি ভুয়া – এই অভিযোগেও একটি মামলা রয়েছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে।

     

    আরটিএনএন



সর্বশেষ খবর


নিউজ খুঁজুন
আর্কাইভ
ফেইসবুক পেইজ