বিশ্বনাথ বিডি ২৪ || 23 May, 2018, 9:29 PM || মুক্তমত
সিলেট বিভাগের মধ্যে বাসিয়া নদীর সমস্যার কথা তুলে ধরবো। ২০০ ফুট প্রস্থের বাসিয়া নদীটি ৪ টি উপজেলায় ৪২ কিলোমিটার জনপদ দিয়ে বয়ে যাওয়া এক সময়ের খরস্রোতা নদী ছিল। অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য রয়েছে এই বাসিয়া নদীতে। এই নদীটি সুরমা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা, বিশ্বনাথ উপজেলা, উসমানী নগর উপজেলা, জগন্নাথপুর উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুশিয়ারা নদীতে মিলিত হয়েছে। এই নদীর সাথে অসংখ্য খাল- বিল, হাওর ও ছোট বড় নদীর সংযোগ রয়েছে।
৯০ দশকে আমি দেখেছি এই নদীতে লঞ্চ, ইঞ্জিনের নৌকা, পালতোলা নৌকা, বালু- পাথরের নৌকা সারি সারি চলতো। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তথ্য মতে- প্রায় ১,৩৬,০০০ হাজার মানুষের যাতায়াতের মূল পথ ছিলো এই বাসিয়া নদীর জলপথ। এবং এই নদী থেকে অনেক সুবিধা ভোগ করে থাকেন। যেমন- জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে, অনেক সৌখিনও মাছ ধরছেন, হাওর, খাল, বিল, নালাতে মাছ এসে পরিপূর্ণ থাকতো। কৃষকরা হাল চাষ করে, বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, অতিরিক্ত ফলন বাহিরে বিক্রি করে পরিবারে সচ্ছলতা আনতো।
দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, আজ এই বাসিয়া নদীটি তার নাব্যতা হারিয়ে মরা খাল বা ড্রেইনে পরিনত হয়েছে। পূর্বের কোন কিছু নেই, তার আগের যৌবন নেই। সে আজ মানবজাতির কাছে অসহায়।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে- কেন নাব্যতা হারিয়ে মরা খাল বা ড্রেইনে পরিনত হলো?
উত্তরটা এভাবে দিতে হয়- নদীর তীরে গঞ্জ, মানব সভ্যতার ইতিহাস গড়ে উঠেছে। কিন্তু, এই বাসিয়া নদীর তীরে গড়ে উঠা গঞ্জ বা বাজারের অধিকাংশ অবৈধ দখল করে কল কারখানা, হোটেল, কেমিক্যাল জাতিয় কারখানার অট্টালিকা তৈরী করেছে। প্রভাবশালী মহল দল মত নির্বিশেষে নদীর দুই তীর অবৈধ দখল করে ৫/৬ তলা ভবন তৈরি করে স্থায়ীভাবে ব্যবসা বাণিজ্য করছে।
এই বাসিয়া নদীর তীরে গড়ে উঠেছে- মাসুদগঞ্জ বাজার, কামালবাজার, মুনশীবাজার, লালাবাজার, বিশ্বনাথ, কালিগঞ্জবাজার, গুদামঘাট, কোনারাইবাজার, রানীগঞ্জ, জামালপুরবাজার, প্রতিটি হাট বাজারের ময়লা আবর্জনা ফেলে নদীটি কে ড্রেইন হিসেবে ব্যবহার করছে এবং পরিবেশ দূষিত করছে কুচক্র মহল। ফলে বৃহত্তর এই নদীটি গভীরতাহীন হয় এখন মাত্র ৬০ থেকে ১০০ ফুটে দাঁড়িয়েছে। সরকারি তালিকা মতে ৫০০ মিটারের মধ্যে ১৬০ টি, ৩ কিলোমিটারে মোট ১৮৬টি অবৈধ স্থাপনা দৃশ্যমান আছে। এবং আমাদের হিসাবে মতে ৪২ কিলোমিটারের মধ্যে ৫০০ শত টি অবৈধ স্থাপনা দৃশ্যমান আছে। বিশ্বানাথ উপজেলা প্রশাসন এই বিশ্বনাথ বাজারের ১৮৬ জন অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ মামলা করেন। মামলা নং ৪/১৭। সিলেট জেলা প্রশাসনক এই ১৮৬ জনকে অবৈধ দখল উচ্ছেদর জন্য নোটিশ দেওয়া হলে-এই মামলার বিপরীতে অবৈধ দখলদার গণ হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন। রিট পিটিশন নং ৯১৩৫/২০১৭, ৫৩৪০/২০১৭ ও ৭৩১২/২০১৩
অন্যদিকে সুরমা নদী থাকে উৎপত্তি বাসিয়া নদীর মুখ ও শেষে কুশিয়ারা নদীর সাথে মিলিত হয়ে যাওয়া বাসিয়া নদীর মুখ পলি মাটিতে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে অনেকে ঐ দুই মুখে অবৈধ স্থায়ীভাবে ঘর বাড়ি নির্মাণ করে ফেলেছে। যার কারণে নদীর স্রোত হারিয়ে গেছে। অন্যদিকে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে নদীর মধ্যভাগে পলি মাটি জমে নদীর তীর ও তল দেশ ভরাট হয়ে গেছে।
আমরা এই বাসিয়া নদী রক্ষার্থে “বাঁচাও বাসিয়া নদী ঐক্য পরিষদ” নামে এইটি সংগঠন গঠন করি। এই সংগঠন থেকে দীর্ঘ দিন যাবত আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছি। আমাদের পক্ষ থেকে মতবিনিময় সভা, আলোচনা সভা, সংবাদ সম্মেলন, স্বারক লিপি দিয়ে আসছি। সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন দপ্তরের যোগাযোগ করে আসছি।
নদী রাক্ষস’রা বাসিয়া নদীটি কে গিলে খেয়েছে। তবে একদিন এই বাসিয়া নদী তোদের (রাক্ষুসের দল) কে উলঙ্গ করে নদীর তীর থেকে তারিয়ে দিবে। এবং নদীর শুরু সুরমা নদীর মুখ খোলে দিতে ও বাসিয়া নদীর শেষে কুশিয়ারা নদীর মুখ খুলে দিতে পারবো, সেই দিন শান্ত হবো। আমাদের বিশ্বনাথ, দক্ষিণ সুরমা, উসমানী নগর ও জগন্নাথ পুর উপজেলা বাসীর স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। নদীর তীরে এই অট্টালিকা গুলো যে দিন ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দিবো সেই দিন সরকারি অর্থায়নে ১০০ কোটি টাকার বাজেট করিয়ে বিশ্বনাথ শহর প্রাণ কেন্দ্রে গড়ে তুলা হবে সৌন্দর্যের “লেগ”, নদীর দুই তীরে থাকবে পাকা করা রাস্তা ও ইষ্টিলের গ্রিল, ফুলের বাগান, রঙিন বাতি জ্বালে ঝলমলে করবে। জনসাধারণ সকাল- বিকেল শিশু বাচ্চা, পরিবার- পরিজন নিয়ে হাওয়া খেতে আসবেন। দূষণ মুক্ত পরিবেশে কে না বেড়াতে মন চায়?
কিন্তু প্রবাসী অধ্যুষিত বিশ্বনাথ শহরে যে পরিমাণ ময়লা আবর্জনা ও দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত। আমাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুল মাদ্রাসা ও হাট বাজারে আসে, আমাদের কাছ থেকে কী শিক্ষা পাচ্ছে? প্রবাসীরা ছেলে মেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে দেশের মাটিতে আসেন, উনারা কী দেখে যাচ্ছেন? বিভিন্ন জেলার সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী চাকরি করতে আসেন, উনারা কী দেখে যাচ্ছেন? অনেক প্রবাসী সমাজ সেবক নামে পরিচিত, এসব কী নজরে আসে না? শুধু চেয়ার পাওয়ার জন্য ছুটাছুটি করলে হবে না, চেয়ারে বসার জন্য মোটা অংকের টাকা অনুদান করলে হবে না, একবার জনস্বার্থে টাকা গুলো ব্যয়ে করেন, টাকা টা জন বহুল স্বার্থে- স্থায়ী কাজে লাগান। অনেক দোয়া পাবেন, জনগণ উপকৃত হবেন।
অনেক গুলি ট্রাস্ট, সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে, পিছনে বাহ্ বাহ্ দিলে হবে না, সরাসরি কথা বলুন, প্রতিবাদ করুন এবং সমাজের দায় থেকে বেঁচে থাকুন।
যদি স্থানীয় সমাজ সেবক, ট্রাস্টি, সংগঠন গুলো সরকারের দিকে না তাকিয়ে, জনপ্রতিনিধির দিকে না তাকিয়ে স্থায়ী জনস্বার্থে কাজে লেগে থাকতেন, তাহলে আজ এসব দেখতে হতো না।
ময়লা আবর্জনা ফেলের জন্য নির্দিষ্ট স্থান খোঁজে পেয়েছি। কিন্তু টাকার অভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছি না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অবগত আছেন। ঐ জায়গাটা উনার পরিদর্শন করে গেছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে শুনেছি গত আইন শৃঙ্খলা সভায় উপস্থাপন করা হয়েছে। কিছু টাকাও কালেকশন করা হয়েছে। যতদূর সম্ভব বাস্তবায়ন হবে।
আপনারা জানেন, গত ২০১৩-১৪-১৫ অর্থ বছরে ৭.৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৮ কিলোমিটার খনন কাজ করেন সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডে। কিন্তু এখানে ১৮ কিলোমিটারের শেষ মাথায় বিশ্বনাথ বাজারের অবৈধ স্থাপনা থাকায় খনন কাজ সম্পন্ন করতে পারেননি। ২০১৬ অর্থ বছরে আবার জলবায়ু পরিবর্তন ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ২ কোটি টাকা বরাদ্দে ৭ কিলোমিটার খনন কাজ আসে। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড আবার বিশ্বনাথ বাজার বাদ দিয়ে খনন কাজ শুরু করলে ৬ কিলোমিটার খনন কাজ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ঐ বিশ্বনাথ বাজারের অবৈধ স্থাপনা থাকার কারণে ১ কিলোমিটার খনন কাজ সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি। এখানে বিশ্বনাথ বাজার থেকে পূর্বে ১৮ কিলোমিটার অসম্পূর্ণ খনন কাজ হয় এবং বিশ্বনাথ বাজারে পশ্চিমে ৬ কিলোমিটার খনন কাজ করা হয়। মধ্যভাগে খনন কাজ অসম্পূর্ণ ১ কিলোমিটার ময়লা আবর্জনা ও অবৈধ দখল করে রাখার কারণে নদী খনন কাজ করা সম্ভব হয়নি। এই ১ কিলোমিটার খনন না করা হলে সরকারের প্রায় ১০ কোটি টাকা জনগণ কোন সুফল ভোগ করতে পারবে না।
এই নদীর সাথে অনেক ছোট বড় নদী, হাওর, বিল, খাল সংযোগ রয়েছে । এই বাসিয়া নদীটি রক্ষা না করায়- বর্ষা মৌসুমে পানি বন্দি হয়ে যাই। এবং শীত মৌসুমে পানি অভাবে কৃষি জমি মরুভূমিতে পরিণত হয়।
আমাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। নদী রক্ষা আন্দোলনে সবাই এগিয়ে আসুন।
সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
লেখকঃ মো. ফজল খান, আহবায়ক- বাঁচাও বাসিয়া নদী ঐক্য পরিষদ।