বিস্তারিত
  • ইফতেখার হোসেন শামিম অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে


    বিশ্বনাথ বিডি ২৪ || 11 May, 2018, 5:52 PM || মুক্তমত


    এ এইচ এম ফিরোজ আলী :: আজ ১১মে। সিলেটের নন্দিত নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ইফতেখার হোসেন শামীমের ৬ষ্ট মৃত্যু বার্ষিকী। ২০১২ সালের ১১মে ভারতে চিকিৎসা শেষে ঢাকা থেকে সিলেট আসার পথে দয়ামির নামক স্থানে ভোর ৫টায় এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় তিনি ইন্তেকাল করেন। গ্রীণ লাইনের একটি বাসের সাথে ওপর একটি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে দূঘটনা ঘটে। এ দূর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রী নাজনীন হোসেন ও কন্যা এডভোকেট শেহজিন ওয়াজিহা হোসেন গুরুতর আহত হন এবং আরো ৭ জনের মৃত্যু হয়। সিলেটের আওয়ামীলীগের রাজনীতির প্রাণ পুরুষ ও কর্র্ণধার ছিলেন ইফতেখার হোসেন শামীম। সিলেটের আওয়ামীলীগের সভাপতি আ.ন.ম শফিকুল হক ও ইফতেখার হোসেন শামীম এ ঝুটিকে চিনেন সারা বাংলাদেশের মানুষ। রাজনীতিতে তাঁরা ছিলেন এক মায়ের সহোদর। অন্তরালে মত পার্থক্য থাকলেও সংগঠনের কাজে ছিলেন ২জন নিবেদিত। ইফতেখার হোসেন শামীম ১৯৭১সালে সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করেছেন। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীর একজন শ্রেষ্ট সন্তান। ৪নং সেক্টরে সর্বজন পরিচিত ও নন্দিত একজন যোদ্ধা। তাঁর ছোট বোন নাসরিন রব রুবা বেগমের স্বামী মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুর রব ছিলেন ৪নং সেক্টর কমান্ডার। শামীম একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হলেও সর্ব ক্ষেত্রে সিলেটের অভিভাকের ভুমিকা পালন করতেন। তাঁর বিকল্প তিনি নিজেই। সিলেটের আওয়ামীলীগ রাজনীতিতে তাঁর শূন্যতা এখন হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছেন দলীয় নেতা কর্মীরা। স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল কেন্দ্র বিন্দু ছিল, বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২নং বাড়িটি। ঠিক তেমনি ভাবে সিলেটের আপদ কালিন সময়ে আশ্রয়ের স্থান ছিল, জিন্দাবাজার পুরান লেনের ইফতেখার হোসেন শামীমের বাড়ি। এরশাদ বিরুধী আন্দোলন এবং উগ্র মৌলবাদদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা আন্দোলনের সুত্রপাত হয় এ বাড়ি থেকে। ইফতেখার হোসেন শামীমের মৃত্যুর পর জিন্দাবাজারের এই বাড়িটিতে নেতা কর্মীদের আনা-গুনা এখন খুবই কম।
    ইফতেখার হোসেন শামীমের বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দেওকলস ইউনিয়নের উলুপাড়া গ্রামে হলেও তিনি জন্ম গ্রহন করেছেন সিলেট শহরে। তাঁর পিতা এডভোকেট ইরশাদ হোসেন ১৯৪৬-৪৭ সালের দিকে সিলেট শহরে আসেন। ১৯৪৯সালের ১৯ডিসেম্বর ইফতেখার হোসেন শামীম জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর মাতার নাম শরিফা খাতুন। তিনি ছিলেন সিলেট অগ্রগামি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা। মায়ের সাথে শামীম এ বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা, সিলেট পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে থেকে এসএসসি পাশ করেন এবং পরবর্তীতে এমসি কলেজে অর্থনীতিতে অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ইফতেখার হোসেন শামীম স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। ফলে তিনি ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারেনি। ছাত্রাবস্থায় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধের শেষ দিকে হরিপুর তামাবিল হয়ে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে সিলেট শহরে প্রবেশ করেন।
    ইফতেখার হোসেন শামীম দুই ভাই ও দুই বোন মধ্যে ছিলেন সবার বড়। তাঁর ছোট ভাই ইমরান হোসেন ইতি মধ্যে মৃত্যু বরণ করেছেন। দুই বোন এখন জীবিত আছেন। ১৯৮২ সালের ৭ফেব্রুয়ারি স্ত্রী নাজনীন হোসেনের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর শ্বশুড় মকসুদ আহমদ চৌধুরী ছিলেন গণপরিষদের সদস্য। স্ত্রী নাজনীন হোসেন এখন সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা। দুই পুত্র হচ্ছেন, স্থপতি ইনতেখার হোসেন ও ইশরাক হোসেন।
    ইফতেখার হোসেন শামীম ছাত্রলীগ যুবলীগ করে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। তাঁর মেধা সাহসিকতা বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সংগঠনকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। সমাজে ও দলে তাঁর শক্তিশালি ভিত ছিল। প্রয়োজনে দল ও সমাজের দু:সময়ে সঠিক অবস্থান ও সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। দলের স্বার্থে তিনি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহন যোগ্যতা ছিল লক্ষ্যণীয়। সাংকৃতিক আন্দোলনে ইফতেখার হোসেন শামীমের ভুমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ৮০ দশকের সাম্প্রদায়িক ঘাতক গোষ্টি যখন সিলেটের শিক্ষা প্রতিষ্টানে প্রগতিশীল ছাত্রদের পায়ের রগকাটা রাজনীতি শুরু করে, তখন একাত্তুরের মুক্তিযোদ্ধা ইফতেখার হোনেস শামীমকে বিষ্ফোরণ মুখর হতে দেখেছি। ১৯৮৮ সালে মুনির, তপন ও জুয়েল হত্যার পর’ স্বাধীনতা চেতনা মঞ্চের, নায়ক ছিলেন শামীম। সিলেটের আখালিয়ায় বিডিয়ার জনতা আন্দোলনে জীবনের ঝুকি নিয়ে সিলেট বাসির পাশে ছিলেন শামীম। শামীম সিলেট বিভাগসহ সকল আন্দোলনে অগ্রভাগে ছিলেন। তিনি সিলেট পৌরসভা, সদর উপজেলা নির্বাচন করে সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। তিনি সিলেটের ১আসন থেকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৯১সালে নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থী মরহুম খন্দকার আব্দুল মালিকের কাছে পরাজিত হন। ইফতেখার হোসেন শামীম ছিলেন একজন বড় মাপের নেতা। আপদে-বিপদে তিনি কখনও বিচলিত হতেন না। সেনা শাসিত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁকে একটি জনসভা থেকে গ্রেফতার করা হলে তিনি একটুও সাহস হারাননি। তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও দায়ের করাতে পারেনি সেনা শাসিত সরকার। আমি কাছ থেকে তাঁকে জানা ও চেনার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি প্রাই আমাকে বলতেন তর মত একটা ছেলে সিলেটের রাজনীতিতে দরকার।
    শামীম ছিলেন একজন কর্মী বান্ধব নেতা। ১৯৯৬সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগের অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে শহর ছেড়ে গ্রামে-গঞ্জে বিচরণ করেছেন শামীম। বিএনপির এক নেতা বিশ্বনাথ আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করলে এগিয়ে আসেন শামীম। ১৯৯৬সালের ৭মার্চ বিশ্বনাথ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মরহুম ইছকন্দর আলী বাড়ি থেকে আ.ন.ম শফিকুল হক ও শামিমের নেতৃত্বে একটি বিশাল মিছিল উপজেলা সদরে আসা মাত্রই প্রতি পক্ষ কয়েকটি বন্দুক দিয়ে গুলি করে মিছিলটি বানচাল করে দেয়। এতে ছাত্রনেতা শায়েক আহমদ, সিতার মিয়াসহ ৭০জন নেতা কর্মী গুরুতর আহত হন। বীর সাহসী শামীম তাঁতে পিছপা না হয়ে মিছিলটি নিয়ে থানা সদরে পৌছে তাঁর চ্যালেঞ্জ রক্ষা করেন। তারপর ১২জুনের নির্বাচনে মুক্তিযোদ্ধা শাহ আজিজ রহমানকে সংদস সদস্য নির্বাচিত করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ২০০৮সালের নির্বাচনে শফিকুর রহমান চৌধুরীকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিজয় নিশ্চিত করেন। তিনি দলের জন্য দিবানিশি কাজ করতে পারতেন। তাঁর কোন অহংকার ছিলনা। দলের যারা তাঁকে অপছন্দ করতেন, তাঁদের কথা মনযোগ দিয়ে শুনে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতেন। অনেকেই বলেন, শামীম নেতা কর্মীদের কথা শুনতেন বেশি, নিজে বলতেন কম। যে কারনে সিলেটের রাজনীতিতে দলীয় কর্মীরা শামীমের জন্য আক্ষেপ আপসোস করছেন। ২০০৫সালের ২৭জানুয়ারি বিশ্বনাথের খাজাঞ্চি ইউনিয়নের রাজাগঞ্জ বাজারে আওয়ামীলীগের বর্ধিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন ইফতেখার হোসেন শামীম। এসময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এএসএম কিবরিয়াকে হত্যার সংবাদ পেয়ে সিলেটে ফিরে আসেন। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন দেশের সর্বনাশ হয়ে গেছে তাড়াতাড়ি মিছিল বের কর। তাঁর নির্দেশে এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বাংলাদেশে প্রথম মিছিল হয় রাজাগঞ্জ বাজারে। বিশ্বনাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে ইফতেখার হোসেন শামীম গর্ব করে বলেছিলেন, এ দেশে অনেকেই রাষ্টপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি হতে পারবেন। কিন্তু কেউ মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবেন না। আমি শামীম একজন মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামীলীগের কোন কর্মীর উপর একহাত তোলা হলে একাত্তুরের সকল হাত সেখানেই প্রতিবাদ জানাবে। তাঁর এমন বক্তব্য শোনে উপস্থিত জনতা মূহমূহ স্লোগান দিয়ে তাঁকে সমর্থন জানায়।
    ২০১২ সালের ১১মে অনুমান ভোর ৫টায় ইফতেখার হোসেন শামীমের মৃত্যুর সংবাদটি মোবাইল ফোনে প্রথমে জানায় আমার অনুজ সংবাদকর্মী তোফাজ্জুল হোসেন। আমি তাঁর কথায় বিশ্বাস না করে পূণরায় জানতে পেরে আবেগ আপ্লুত হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। কিছু সময় পর আমার ছেলে রায়হান ফিরোজ সৌরভ (৯) পুকুরে সাতাঁর কাটতে গিয়ে মারাত্মকভাবে পা কেটে ফেলে। তাঁর প্রচুর রক্তপাত হচ্ছিল। আমি ছেলেটিকে না দেখে সিলেট আলিয়া মাদরাসা মাঠে মুক্তিযোদ্ধা শামীমের জানাজায় শরীক হই। জানাজা শেষে ওসমানী হাসপাতালে ছেলেটিকে নিয়ে গেলে গভীর রাতে তার পায়ে দীর্ঘ সময় অপারেশন হয়। ইতি মধ্যে ছেলেটি মৃত্যুর পথযাত্রী হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা শামীমকে শেষ শ্রদ্ধা করতে গিয়ে ছেলেটির চরম বিপদে পিতা হয়ে পাশে থাকতে পারনি। এ স্মৃতি আমাকে বারবার পীড়া দেয়। মানব সৃষ্ট দূর্যোগ সড়ক দূর্ঘটনা এবং প্রাকৃতিক দূর্যোগ বজ্রপাত এ দেশে এখন ভয়ংকর রুপ ধারন করেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, সুনামগঞ্জের পৌর মেয়র কবি মমিনুল মইজ উদ্দিন চলচিত্র নির্মাতা তারেক মিশুক ইফতেখার হোসেন শামীমসহ শতশত জ্ঞানী মেধাবি লোক সড়ক দূর্ঘটনায় খুন হচ্ছেন। শামীমের মৃত্যুর পর সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরনের প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে। কিন্তু শামীমের স্মৃতি রক্ষায় কোন উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি। শীঘ্রই সড়ক দূর্ঘটনা রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন জরুরী। ইফতেখার হোসেন শামীম ছিলেন এক কথার লোক। তিনি যা বলতেন তাই করতেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা শামীমের রুহের মাফেরাত কামনা করছি। তিনি অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন সিলেটের মানুষের হৃদয়ে।

    লেখক :- কলামিষ্ট



সর্বশেষ খবর


নিউজ খুঁজুন
আর্কাইভ
ফেইসবুক পেইজ