বিস্তারিত
  • মুমিন আহমেদ এর জীবনের গল্প


    বিশ্বনাথ বিডি ২৪ || 25 August, 2021, 7:34 PM || বিশ্বনাথ, মুক্তমত


    আশা করছি আমার জীবনের এই গল্পগুলো আপনাকে কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত করবে। আচ্ছা, কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে তুমি কি জীবনে সফল? উত্তরে আমি হয়তো বলবো না! কিন্তু আমার বা আমাদের জীবনে সফলতা দেখানোর মত অনেক কিছুই আছে। মানুষের বাহ্যিক দিক দেখে তার সম্পর্কে বিশ্লেষণ আমরা অনেকেই করি।

    কিন্তু একটা মানুষের পুরো জীবন জানা কারো পক্ষেই সম্ভব না আর সেটা না জেনেই আমরা তার সম্পর্কে বিশ্লেষন করতে থাকি। তবে যা শেয়ার করছি সেটার দ্বারা এটা বুঝানো না যে আমি বিশাল কোনো ব্যাক্তিত্ব।

    আমি ক্ষুদ্র, জগতের ক্ষনস্থায়ী একজন বাসিন্দা। যা জ্ঞান অর্জন করেছি সেটি জিরো থেকে হয়তো কিঞ্চিৎ বেশী। আমার ছেলেবেলা থেকে শেখার প্রতি ছিল ব্যাপক আগ্রহ। অন্য অনেকের মত আমিও ভাবতাম আমার হাটার সাথে সাথে চাঁদও কেন আমার সাথে হাটে! আকাশ দিয়ে বিমান চলে গেলে ভাবতাম এত ছোট বিমানে কীভাবে এত মানুষের জায়গা হয়! টিভি দেখার সময় মনে হত চরিত্রগুলোকে হয়তো কোনো জাদুকর জাদু দিয়ে এত ছোট বাক্সে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এগুলো বললাম কৌতুহলী মন ছিল বুঝাতে। যেসকল জিনিষের প্রতি আগ্রহ রয়েছে সেগুলো শেখার জন্য জীবনে অন্তত একবার হলেও চেস্টা করেছি।

    গল্প এক

    ক্লাস থ্রী কিংবা ফোর থেকেই আমার মুভি দেখার দারুন শখ। স্কলারশীপের টাকা পেলেই অনেকগুলো মুভি একসাথে কিনে আনতাম। মুভি দেখে দেখে কিছু ইংরেজি মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।

    ইংরেজি বলা কিংবা শুনায় বেশ পটু ছিলাম। অ্যানিমেশনের কথাবার্তা আমি বেশীরভাবই বুঝতে পারতাম। ধীরে ধীরে আমার ইংরেজির প্রতি আগ্রহ প্রবলভাবে বাড়তে থাকে। প্রথমবারের মত আমি যখন লার্নিং পয়েন্টে ভর্তি হই তখন থেকেই ইংরেজি শিখতে হবে এমন একটা ধ্যান-ধারনা সর্বদাই কাজ করতো।

    সপ্তাহে ১২টা স্পীকার্সক্লাব আমি করতাম। রোদ-বৃস্টি কোনো কিছুতেই আমার স্পীকার্সক্লাব মিস হয়েছে এমনটা হয়নি। ইংরেজি বলবো কিন্তু আমার বলা হতে হবে অন্যদের থেকে ভিন্ন এই কারনে প্রনানসিয়েশন ও একসেন্ট এর উপর জোর দিতে শুরু করলাম। ইউটিউবের ইংলিশ-লার্নিং এর শতশত ভিডিও আমার কম্পিউটারে ছিল।

    ভালো ভালো ন্যাটিভ স্পীকার্সদের কথা ফলো করতাম এবং তাদের মত কথা বলার চেস্টা করতাম। পাবলিক স্পীকিং দেখতাম, বডি ল্যাংগুয়েজ নিয়ে কাজ করতাম। প্লে¬-স্টোর থেকে অ্যাপ ডাউনলোড করেছিলাম প্রতিদিন নতুন নতুন শব্দ শেখার জন্য। স্কাইপ কিংবা ফেসবুকে ইংরেজি শিখছে এমন মানুষদের সাথে কথা বলার চেস্টা করতাম, তাদের সাথে কানেক্টেড থাকার চেস্টা করতাম।

    আমার প্রতিদিন সকালের রুটিন ছিল অনলাইনে দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকাটি পড়া যার অভ্যাস এখনো রয়েছে। অনলাইন-অফলাইনের ভিন্নভিন্ন ক্লাবে অংশগ্রহন করতাম নতুন কিছু শেখার আশায়। ভার্সিটিতে পড়াকালীন প্রথমদিকে সাস্টের একটি স্পীকিং কম্পিটিশনে অংশগ্রহন করে টপ টেন একজন স্পীকার নির্বাচিত হয়েছিলাম।

    আলহামদুলিল্লাহ, যে প্রতিষ্ঠানে ছিলাম ছাত্র একসময় সেখানেই টিচার হিসেবে জয়েন করার সুযোগ পেয়ে গেলাম। পাশাপাশি এত ছাত্র-ছাত্রী পেয়েছি যাদের নিয়ে গর্ব হয়। যারা আমাকে দিয়েছে অফুরন্ত সম্মান আর ভালোবাসা। এমন অনেক সহকর্মী পেয়েছি যাদের মধ্যে থাকতে পারাটা আমার কাছে সৌভাগ্যের। যাইহোক, এখন সবচেয়ে মজার একটা বিষয় হচ্ছে তখনকার সময়ে আমার কিছু বন্ধু আমার ইংরেজি নিয়ে হাসতো, ভুল উচ্চারন শুনে মজা করে বলতো তুমি একজন ব্রিটিশ স্পীকার হবে।

    আলহামদুলিল্লাহ, আজ তারাই আমার কাছে ইংরেজি শেখার টিপস চায়। কয়েকজনতো আমার সরাসরি ক্লাস করেছে। অ্হংকার নয় এগুলো। তবে আমার সব বন্ধু যে এরকম করতো তা অবশ্যই নয়। আমার এমন অনেক বন্ধু আছে যারা আমাকে সাপোর্ট করতো, আমাকে নিয়ে গর্ব করতো। তাদের প্রতি আমার রয়েছে অগাধ ভালোবাসা। যাইহোক, সব কিছুর পরে আমি একটা কথাই ভাবি। আমি কোনো হিরো না! হিরো হওয়ার যোগ্যতাও নেই। তবে প্রতিনিয়তই সবকিছু, সবার থেকে আমি শিখি যা আমার জীবনে ভ্যালু অ্যাড করে। আমার বিশ্বাস সবার থেকে শিখতে পারাটাই সাফল্যের আরেকটি অংশ।

    গল্প দুই

    আচ্ছা, কখনো কারো কথায় কস্ট পেয়েছেন? প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ শত কথার আঘাতে ভিতর ভিতর মারা যায়। আমিও একবার মরেছিলাম। আমি যখন প্রথমবারের মত আজাদ জীমে ভর্তি হলাম একদম চিকন অবস্থা।

    আমার বন্ধু আমাকে বলেছিল তুই বডিবিল্ডিং করে কী করবি? তোর হাইট কম! জীমে গেলে আরো খাটো হবি। কথা গুলোয় কস্ট পেয়েছি। খাটোরা কী জীমে যায়না? তারপর এক মাস হয়েছে জীমে আমার স্কুলের এক বন্ধুর সাথে দেখা।

    মাশাআল্লাহ বডি দেখতেও ফিট। আমি তাকে তুই করে বলতাম যেটা বন্ধু হিসেবে আমি শুরু থেকেই তাকে বলি। একদিন সে আমাকে একটু আড়ালে নিয়ে বললো বন্ধু, মাইন্ড করিস না! আমাকে সবার সামনে তুই করে বলিসনা! হয়তো আমার সাথে ওর স্ট্যাটাস আর এখন যায়না। আমি ভিতর ভিতর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন অবস্থা। কোনো রকম তার সামনে থেকে চলে আসলাম।

    পরবর্তী কয়েক বছর আমিও কিন্তু জীমে একটানা গিয়েছি। আমারোও কিন্তু ভালো একটা ফিটনেস এসেছিল যেটা যে কেউই দেখে প্রশংসা করতো। আমি বারবেল লেগ-স্কোয়াডে ১২০ কেজি নিতে পারতাম। এটা যে আহামরি কিছু এমন না। তবে আমার হাইটে আমার ভালো একটা ফিটনেস হয়েছিল আলহামদুলিল্লাহ।

    আমি এটা পরে আমার অনেক বন্ধুদের সাথে শেয়ার করেছিলাম এবং বলেছিলাম যে যদি আমার জীবনে কোনো মন্ত্রী-এমপিও হয়ে যাই সবার সামনে আমাকে যেন আমার বন্ধুরা নাম ধরে কিংবা তুই করে বলে। তখনই আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন খাটি প্রমান হবে। গল্প তিন গিটার শেখার ইচ্ছা আমার অনেক আগ থেকে। গানের প্রতি একটা আবেগ ছিল বোধ হয় সেকারনেই। একবার এক বন্ধুর ঘরে প্রথমবার গিটার হাতে নেয়ার সুযোগ পাই।

    পরে ভার্সিটিতে প্রথমবার গিটার হাতে কাউকে গান গাইতে দেখি। তখন এক ভাইকে প্রশ্ন করেছিলাম আমি শিখতে পারবো কিনা! ভাই আমাকে ভদ্র ভাষায় বললেন এটা স্ট্রীং ইন্স্ট্রুম্যান্ট, এত সহজ না শেখা। তাছাড়া আমার হাত দেখে উনি বললেন আমার হাত দিয়ে সবগুলো কর্ড, বিশেষ করে বার-কর্ড ধরতেই পারবোনা। কস্ট পেলাম।

    পরে বিশ্বনাথেই রিদম মিউজিক একাডেমীর মুহিন ভাইয়ের মাধ্যমে আমার গিটারে হাতে-খড়ি হলো। খুব প্র্যাকটিস করতাম। মেজর-মাইনর স্ক্যাল, মেজর-মাইনর কর্ড, ফিংগার প্র্যাকটিস, বিভিন্ন গানের সাথে রিদম প্র্যাকটিস সর্বশেষ সবার সাথে বাজানো সবমিলিয়ে কয়েক বছরেই গিটার বাজানোয় বেশ পারদর্শী হয়ে গেলাম।

    আমি কিন্তু প্রফেশনাল গিটারিস্ট না, আমার সেটা হওয়ার ইচ্ছাও নেই। দিনশেষে, যেটায় আমার কৌতুহল সেটা শিখতে পারাটাই আমার কাছে আনন্দের একই সাথে সাফল্যের। গল্প চার সময়টা বেশ কঠিন চলছে। এমনিতেই স্কুল লাইফে কোনো এক কারনে আমার এক বছর পড়াশুনায় গ্যাপ পড়ে গেলো। আমার বন্ধুরা চলে গেল ক্লাস নাইনে আর আমি নাইনে উঠে স্কুল বদলি করে আবার ক্লাস এইটে পড়লাম এক বছর। তারপর এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হলাম দক্ষিন সুরমা কলেজে। বিষয় দর্শন। ৩য় বর্ষে গিয়ে বাইরের যাওয়ার চেস্টা করবো এ কারনে ভর্তি বাতিল করে সার্টিফিকেট তুলে ফেললাম।

    পরে আর বাইরেও যাওয়া হলোনা। অবশ্যই এটা ছিলো জীবনের বল্ড একটা ডিসিশন যেটা আমার জীবনে বিশাল একটা ভ্যালু অ্যাড করেছে। প্রায় সবার মতামতের বাইরে গিয়েই আবারো অনার্সে ভর্তি হলাম সিলেটের স্বনামধন্য মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে। বিষয় আমার সবসময়কার পছন্দের ইংরেজি। তখন অনেকেই আমাকে বলেছিল এটা যেন না করি। শেষ করতে পারবোনা, পড়াশুনার চাপে একসময় হাল ছেড়ে দিতে হবে কিংবা বাইরে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হোক সেটা মিডলইস্ট।

    এমন মন্তব্যে আমি নিজেও বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার বিশ্বাস আমি আমার লক্ষ্যে ছিলাম দৃঢ়। আর তাই আজ একে একে আমার চার বছর শেষ হয়ে গ্যাজুয়েশনের একদম দ্বারপ্রান্তে। আমি এটা কোনোরকমে শেষ করেছি এমনও না। এটা ভালো রিজাল্ট নিয়েই শেষ হবে এই আশাবাদী। যারা আমাকে বলেছিল আমি পারবোনা তারা অনেকেই তাদের জায়গায় ঠিকই রয়ে গেছে কিন্তু আমার সাফল্যের খাতায় অনার্স নামের সফলতার পালক আল্লাহ চাইলে যুক্ত হতে চলেছে শীঘ্রই, আলহামদুলিল্লাহ। যারা আমাকে ভালো করে চিনেন তারা জানেন আমি কেমন হাস্যরসপ্রিয় মানুষ।

    এটার জন্যও আমি সরাসরি কিংবা গোপনে তিরস্কৃত হয়েছি অনেকবার। কিন্তু তারা হয়তো জানেনা আমার এই গুণের কারনেই হাজার জনের কাছে আমি সমাদৃত হয়েছি। যে কারনে হাজার মানুষ আপনাকে ভালোবাসে সেই কারনে যদি কিছু মানুষ আপনাকে ভালো নাও বাসে তাহলে কি-ই বা আসে যায়! সবাই কি সবার কাছে সব জায়গায় আস্হাভাজন-প্রিয় হয়ে থাকতে পারে? সেগুলো নিয়ে আমি বিন্দু পরিমান ট্রাস্ট মি বিন্দু পরিমান ভাবিনা। একদম অহংকার করে বলছি না, সত্যি।

    শেষে শুধু বলবো মানুষ জীবনে সব কাজে সফল হয়না। হওয়াও সম্ভব না। কিন্তু যেগুলোই আপনার জীবনে ভ্যালু অ্যাড করেছে, আপনাকে সমাজে সমাদৃত হতে সাহায্য করেছে, মানুষের ভালোবাসা পেতে সাহায্য করেছে সেগুলো ভেবে নিজেকে কিছুটা সফল মনে করাটা বোধ হয় অনুচিত হবেনা। মানুষের সমালোচনা, আপনাকে কোনো কাজে নিরুৎসাহিত করাটা কখনোই আপনাকে আটকাতে পারবেনা যদি আপনার ইচ্ছা থাকে মজবুত আর আপনি সে ইচ্ছায় থাকেন অটল, আর লক্ষ্যে কাজ করে যান নিরন্তর। তাহলে সফলতা আসবেই।

    দিনশেষে, আপনার ভরনপোষণ, আপনার দায়িত্ব আপনি কিংবা আপনার পরিবারই নেয়। সমাজের ওই সব মানুষ না যারা আপনার কখনোই শুভাকাংখী হতে পারেনি আর পারবেও না। মহান আল্লাহ যেন আমাদের অহংকারী না বানান এবং জীবনের প্রতিটি ভালো কাজকে সহজ এবং সফলতা দিয়ে পরিপুর্ণ করে দেন। আমীন।

    লেখক : মুমিন আহমেদ, শিক্ষক, লার্নিং পয়েন্ট। তাং- ২০আগস্ট, ২০২১ইং



সর্বশেষ খবর


নিউজ খুঁজুন
আর্কাইভ
ফেইসবুক পেইজ