বিস্তারিত
  • ফরিদের মতো পরোপকারী মানুষ জীবনে দেখিনি


    বিশ্বনাথ বিডি ২৪ || 07 October, 2019, 7:41 PM || কলাম, বিশ্বনাথ


    মো. মঈন উদ্দিন:- ফরিদের মৃতদেহ কবরে রেখে আসলাম গত শুক্রবার জুমার নামাজ পরবর্তী জানাযার নামাজ শেষে। তার কবরও দেয়া হয়েছে গ্রামের মেঠো পথের ধারে যে পথের ঘা ঘেষে ছুটে চলেছে বাসিয়া নদী। তার কবরটি যেখানে দেয়া হয়েছে ঠিক সেখানেই নদীর অই তীরে কত বিকেল আমরা একসাথে কাটিয়েছি তার সাথে হিসেব নেই। দেখেছি কত স্বপ্ন একসাথে, শৈশবের দুরন্তপনার সময়, কৈশোরে বেড়ে উঠার সময়, তারুণ্যের রঙিন স্বপ্নে বিভোর থাকার সময় কবরের ঠিক অই জায়গাটায় ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে কাটিয়েছি, কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে, টেরই পাইনি। ফরিদ, আমার সেই হতভাগা বন্ধুটা, যে সারাজীবন শুধু বিদেশে বা ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন দেখেতো।

    ভাল কোন দেশে সেটেল হওয়ার জন্য সে পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছে শুধুমাত্র পাসপোর্টে আরো বেশি সিল মারানোর জন্য। অবশেষে সে ইউরোপ গিয়েছিল তবে সে যাওয়া ছিল লাশ হয়ে ফিরে আসার জন্য। ক্যারিয়ার, জীবন কিংবা পরোপকার কোন কিছুতেই সে হিসেব করতোনা। তার জীবন দর্শন ছিল ‘কী আছে জীবনে’ টাইপের। সে যতদিন বেঁচেছিল, এভাবেই বেঁচেছিল। মানুষ কিভাবে মানুষকে এতো উদারভাবে হেল্প করে করতে পারে, এতো সহজে অন্যান্য মানুষদের সাথে মিশতে পারে তা আমি নিজ চোখে দেখিছি কিন্তু শিখতে পারিনি। কারণ কেউ ইচ্ছে করে ফরিদ হতে পারে না, কেউ কেউ আসলে ফরিদ হয়ে যায়। তার হালির হালি ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে এমন কোন বন্ধু  নেই যার কিচেন পর্যন্ত ওর যাতায়াত ছিলনা।

    সে যেমন ছিল বন্ধুদের প্রিয়, তেমনি বন্ধুদের পরিবারের সবারও প্রিয়, কারণ সবার সাথে মিশে যাওয়ার ওর সহজাত ক্ষমতা ছিল ওর। যতদিন বেঁচেছিল, ও নিজের মত বেঁচেছিল। কোন কিছুই তাকে ছকে বাঁধতে পারেনি, যদিও এই পরিকল্পনাহীন জীবনের জন্য সে কম ভুক্তভোগী হয়নি। তার অনেক হাই প্রোফাইল বন্ধুদের ভিড়ে সে একটু পিছিয়েই পড়েছিল কিন্তু তার এ নিয়ে আক্ষেপের চেয়ে গর্বই বেশি ছিল। সে মনে করতো, তার বন্ধুদের অর্জন মানে তার অর্জন। আমি সত্যি বলছি, তার মত এতো পরোপকারী মানুষ আমি আমার জীবনে দেখিনি।

    এরকম একজন প্রাণের বন্ধু স্লোভাকিয়ার জংগলে মারা যাবে, কেমনে নিজেরে বুঝাই, কেমনে মেনে নেই। কিন্তু এখন এটাই নির্মম বাস্তবতা যে ও আর বেঁচে নেই। চিরতরে হারিয়ে গেছে আমাদের মাঝথেকে। সেই বন্ধু যার কাছে ছুটে যেতাম যখনি কোন সমস্যায় পড়তাম। যার সাথে আমার ভাল লাগা, মন্দলাগা প্রাণ খুলে শেয়ার করতে পারতাম। সেই প্রিয় বন্ধুর জীবন প্রদীপ হঠাৎ করেই নিভে গেল। সে মনেহয় জানতো যে, সে বেশিদিন বাঁঁচবেনা। তাই জীবনকে সে তারমত যাপন করত। আড্ডা দিতে খুব পছন্দ করত, ঘুরতে খুব পছন্দ করতো, যেকোনো মানুষকে সাহায্য করতে খুব ভালবাসত। ক্যারিয়ার নিয়ে এতটা সিরিয়াস ছিলনা।এদেশের অনেক অসংগতি নিয়ে, সিস্টেম নিয়ে তার মাঝে হতাশা ছিল। সেই হতাশা এবং বিদেশ নিয়ে তার অস্বাভাবিক মোহ তাকে এতদুর টেনে নিয়ে গিয়েছে। সেই দূর এতো দূর যে, যেখান থেকে কেউ কোনদিন ফিরে আসেনা। সে মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগেও আমার সাথে কথা বলেছিল।

    সে কিছুদিনের মধ্যে গেমঘরে (দালালদের তথাকথিত ঘর) চলে যাবে জানিয়ে আমার কাছে খুব সিরিয়াসলি দোয়া চেয়েছিল। ওতো আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবেনা। কিন্তু ওর সাথে কাটানো জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর স্মৃতিগুলো কষ্ট হয়ে ফিরে আসবে যতদিন বেচে থাকব। শেষের কবছর আমার সাথে ওর বেশ দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল, এ নিয়ে ওর উপর আমার কম ক্ষোভ ছিলনা। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমার হৃদয়ে ওর জন্য শুধু ভালবাসাটুকু অবশিষ্ট আছে। খুব আফসোস হয় আরো কিছুদিন যদি আমরা একসাথে হাসি-আনন্দে কাটাতে পারতাম যা আর হবার নয়। Learning Point প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ওর অবদান, বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণের স্মৃতি, ওর হাসিমুখ, নিরহংকার ব্যাক্তিত্য, সরলতা কোনকিছুই কোনদিনই ভুলতে পারবো না। ওর মৃত্যু আমাকে নতুন করে শিখিয়ে গেলো, মৃত্যু মানুষের জীবনের চরম সত্য হলেও এর সময় একেবারেই অননুমেয়।

    লেখক: মো. মঈন উদ্দিন,  প্রতিষ্ঠাতা লার্ণিং পয়েন্ট।



সর্বশেষ খবর


নিউজ খুঁজুন
আর্কাইভ
ফেইসবুক পেইজ