বিস্তারিত
  • মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ের গুরুত্ব : মো. মঈন উদ্দিন


    বিশ্বনাথ বিডি ২৪ || 04 October, 2018, 7:03 PM || মুক্তমত


    বিশ্বনাথ বিডি ২৪ :: কোনো জনগোষ্ঠীর মানসম্মত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার তাৎপর্যপূর্ণ পূর্বশর্ত হচ্ছে মানুষের মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে নির্ণয় করা। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ৯ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুবরণকারী এই বিপুল মানুষের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। অবশিষ্ট ৮৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে-গঞ্জে নিজ বাড়িঘরে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা হাসপাতালে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে যে কারণগুলো উল্লেখ করেন, সেগুলো হলো শ্বাস-প্রশ্বাসক্রিয়া বন্ধ, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ—অর্থাৎ হার্ট ফেইলিওর, স্ট্রোক, ব্রেনডেথ ইত্যাদি। মৃত্যুর এই তথাকথিত কারণগুলো জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখে না; বরং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে ভুল পথে ধাবিত করে। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসযন্ত্র—অর্থাৎ ফুসফুস ও হৃদযন্ত্র বা হার্ট বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হব না। এগুলো ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত মৃত্যুর কারণ, যা ব্যাপকভাবে আমাদের দেশের চিকিৎসকরা লিখে থাকেন। হৃদযন্ত্র বা শ্বাস-প্রশ্বাসযন্ত্র বন্ধ হওয়ার কারণ নির্ণয় করতে পারলেই শুধু মৃত্যুর অন্তর্নিহিত কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হবে।

    জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ের তাৎপর্য উপলব্ধি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৬৭ সালে হাসপাতালে মৃত্যুর কারণ IMCCoD (International form of Medical Certification of Cause of Death)-এর মাধ্যমে নির্ণয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই সিদ্ধান্ত উন্নত সব দেশ গ্রহণ করলেও বাংলাদেশসহ এশিয়া-আফ্রিকার কিছু দেশ IMCCoD প্রয়োগ করে মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইনসহ অনেক দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী IMCCoD প্রয়োগ করে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করছে। আমাদের প্রতিবেশী অন্যান্য দেশও মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মৃত্যুর কারণ বিষয়ক মানচিত্রে আমাদের অবস্থান ‘no data group’ ক্যাটাগরিতে।

    ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত মৃত্যুর কারণ ভবিষ্যৎ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। আমরা মৃত্যুর কারণ হিসেবে শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া ছাড়া আরো যেসব মামুলি কারণ উল্লেখ করি, তা হলো বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু, ডায়াবেটিসে মৃত্যু, মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মৃত্যু ইত্যাদি, যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় কোনো কাজে আসে না। হাসপাতালে কোনো মৃত্যুকে যখন হার্ট অ্যাটাক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন মৃত্যুর সঠিক কারণ থেকে আমরা অনেক দূরে চলে আসি। মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয় করতে পারলেই শুধু আমরা প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু প্রতিরোধ করতে পারব। কী ধরনের ওষুধ ও চিকিৎসকের প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করতে পারব। অন্যথায় জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে এসব মৃত্যুকে আমরা সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করি। সড়ক দুর্ঘটনা কোথায়, কিভাবে হয়েছে, তা উল্লেখ করি না। ফলে কোন স্থানে বা কোন হাইওয়েতে কী ধরনের যানবাহন বেশি দুর্ঘটনায় পতিত হয়, সে তথ্য আমাদের কাছে না থাকায় আমরা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী দুর্ঘটনার স্থান, দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহনের ধরন এবং দুর্ঘটনার বর্ণনা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়।

    বিজি ফরম নম্বর ৮০৪ অনুযায়ী বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী ওই ফরমের মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। কারণ এই ফরমের মাধ্যমে সংগৃহীত বিপুলসংখ্যক মৃত্যুর কারণ ICD (International Statistical Classification of Diseases) কোডে রূপান্তর করে সংরক্ষণ করা অসম্ভব হওয়ায় তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর ওপর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করা যায় না। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রবর্তিত IMCCoD ফরমের মাধ্যমে মৃত্যুর প্রধান ও অন্তর্নিহিত কারণগুলো এবং মৃত্যু ঘটানোর জন্য দায়ী কারণগুলো সহজেই চিহ্নিত করে ICD কোডে DHIS-২ (উরংঃত্রপঃ Health Information System-2)-এ ডিজিটালি সংরক্ষণ করা যায়। উঐওঝ-২-তে সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্ত সহজে জনকল্যাণে বিচার-বিশ্লেষণ করে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়নে কাজে লাগানো যায়।

    মৃত্যুর কারণ নির্ণয় পদ্ধতি উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তত্ত্বাবধানে ‘Technical Support for CRVS System Improvement in Bangladesh’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি যুক্তরাষ্ট্রে ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিস এবং অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিগরি সহায়তা পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এই কর্মসূচির নাম ব্লুমবার্গ ডাটা ফর হেলথ (BD4H) ইনিশিয়েটিভ। এই ইনিশিয়েটিভের আওতায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের কার্যক্রম প্রথমে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ-মিটফোর্ড হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং গাজীপুর জেলার শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চালু করে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হওয়ায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ প্রথম প্রজন্মের সব বিভাগীয় হাসপাতালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী মৃত্যুর কারণ নির্ণয় কার্যক্রম চালুর যুগান্তকারী অনুমোদন প্রদান করে। সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশালের প্রথম প্রজন্মের বিভাগীয় হাসপাতালগুলো নিজস্ব অর্থায়নে IMCCoD চালু করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় হাসপাতালে মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ে এক অনন্য নজির স্থাপন করে।

    আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মৃত্যুবরণকারী ৯ লাখ মানুষের মধ্যে ৮৫ শতাংশ নিজ বাড়িঘরে চিকিৎসকের সরাসরি তত্ত্বাবধান ছাড়া মৃত্যুবরণ করে। এসব মৃত্যুর কারণ ‘বাচনিক ময়নাতদন্ত’ বা verbal autopsy-র মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়। BD4H ইনিশিয়েটিভের আওতায় গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারীদের বাচনিক ময়নাতদন্তের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তাঁরা মৃত ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয়ের কাছ থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর স্মার্ট ট্যাবে সংগ্রহ করে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে Open Data Kid (ODK) সার্ভারে প্রেরণ করে প্রায় কাছাকাছি মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করছেন।

    বাংলাদেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে IMCCoD প্রয়োগ করে মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ের উদ্যোগ ন্যাশনাল মরটালিটি টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ গ্রহণ করেছে। চলতি অর্থবছরে জেলা পর্যায়ের ৫৭টি সরকারি হাসপাতালে BD4H এবং সরকারের উদ্যোগে IMCCoD কার্যক্রম চালু হবে। এ ছাড়া ঢাকা শহরের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে IMCCoD কার্যক্রম চালুকরণের জন্য চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ৭৫ হাজার চিকিৎসক আছেন। তাঁদের সবাইকে সামনাসামনি (প্রত্যক্ষ) IMCCoD প্রশিক্ষণ প্রদান করা সম্ভব হবে না। তাই IMCCoD এবং বাচনিক ময়নাতদন্তের মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ নির্ণয়বিষয়ক পাঠ এমবিবিএস সিলেবাসে বিস্তারিতভাবে অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য সেন্টার ফর মেডিক্যাল এডুকেশন বিএমডিসিকে অনুরোধ করেছে। আশা করা যায়, শিগগিরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়বিষয়ক পাঠ এমবিবিএসের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হবে।

    বাংলাদেশ অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৫ সালে এমডিজি বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য খাতের অবদান অপরিসীম। মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রভূত উন্নতি ঘটিয়ে ২০৩০ সালে এসডিজির সংশ্লিষ্ট টার্গেট অর্জনসহ ২০৪১-এ বাংলাদেশকে এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে স্বাস্থ্য খাত উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

    লেখক : সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও কান্ট্রি কনসালট্যান্ট, ডাটা ফর হেলথ-সিআরভিএস

    সূত্র : কালেরকণ্ট।



সর্বশেষ খবর


নিউজ খুঁজুন
আর্কাইভ
ফেইসবুক পেইজ